অমর নায়ক সালমান শাহ। যিনি আজও বাংলা দর্শকের মনে চিরস্থায়ী ভাবে জায়গা করে নিয়েছেন। সালমান শাহ ছিলেন একজন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কীর্তিমান অভিনেতা, মডেল ও ফিল্ম হিরো। তার প্রকৃত নাম ছিল শাহরিয়া চৌধুরী ইমন। তার মিডিয়াতে পথচলা শুরু হয় টেলিভিশন নাটক দিয়ে। এই টিভি নাটকে তার অভিনয়জীবন শুরু হলেও ১৯৯০-এর দশকে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অন্যতম জননন্দিত শিল্পী হয়ে উঠেন। হয়ে উঠেন বাংলার অমর নায়ক।
১৯৯৩ সালে তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত কেয়ামত থেকে কেয়ামত। ছবিটির হিন্দি ছবিত বাংলা ভার্সনের কপিরাইট কিনেন চিত্রপরিচালক সোহানুর রহমান সোহান।এই মুভিটি সালমান শাহ ও মৌসুমীর অভিষেক চলচ্চিত্র। এছাড়া সালমান শাহ ও মৌসুমি নায়ক নায়িকা হিসেবে এই ছবিতে অভিষেক হওয়ার পাশাপাশি অভিষেক হয় গায়ক আগুন এরও। জনপ্রিয় এই ছবিটি নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশের সাড়া জাগানো অনেক চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রটি ছিল ব্যাপক ব্যবসাসফল।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিটি ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হয় বাংলাদেশে। ছবিটি পরিচালনা করেন সোহানুর রহমান। এই ছবিটি ১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র “কায়ামত সে কায়ামত তাক” এর পুনঃনির্মাণ। হিন্দি চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আমির খান ও জুহি চাওলা।
হিন্দি চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখেছিলেন নাসির হোসেন খান, যার বাংলা চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সোহানুর রহমান সোহান ও সংলাপ লিখেছিলেন অশীষ কুমার লোহ। বাংলা চলচ্চিত্রটির প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষ এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড।
এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন সালমান শাহ, মৌসুমি, রাজিব, আহমেদ শরীফ, আবুল হায়াত প্রমুখ। প্রথবারের মত এই সিনেমায় সালমান শাহ ও মৌসুমি জুটিবেঁধে কাজ করেছিলেন। এটি সালমান শাহ ও মৌসুমি অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। এই ছবিতে প্রথমবারের মত চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দেন হয় কণ্ঠশিল্পী আগুন।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটির গল্পে উঠে আসে দারূণ এক রোমান্টিক হৃদয়বিদারক কাহিনী। একই গ্রামে দুটি প্রভাবশালী পরিবার।মির্জা পরিবার ও খান পরিবার। খান পরিবারের ছেলে খান বাহাদুর কবিরউদ্দিন মির্জা পরিবারের মেয়ে ডিম্পলের সাথে অবৈধ মেলামেশার ফলে ডিম্পল গর্ভবতী হয় পরে। এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে বড় মির্জা খান বাহাদুর রইসউদ্দিনের কাছে তাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।
কিন্তু কবিরউদ্দিন পরিবারে সম্মানের ভয়ে মিথ্যা বলে। বড় মির্জা ক্ষুদ্ধ হয় ফিরে আসে। এদিকে কবিরউদ্দিন ডিম্পলকে অস্বীকার করেছে জানার পর ডিম্পল লজ্জায় ক্ষোভে আত্মহত্যা করে। তখন মির্জা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ডিম্পলের মৃতদেহ নিয়ে খান বাড়িতে যায় এবং সে কবিরউদ্দিনকে গুলি করে খুন করে। খুনের দায়ে সালাউদ্দিনের জেল হয়ে যায়। আর বড় মির্জা সবাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
বিশ বছর পর সালাউদ্দিন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তার ছেলে রাজের কলেজে গিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সালাউদ্দিন রাজকে গ্রামে একটি কাজের জন্য পাঠায়। সেখানে তার রেশমি নামের এক মেয়ের সাথে দেখা হয়। পরে শহরে এসে তাদের আবার তাদের দেখা হয়। এম্ন দেখা সাক্ষাতে তাদের মধ্যে প্রেম গড়ে উঠে। কিন্তু তাদের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাদের দুই পরিবারের কেউই তাদের প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। বরং তাদের দুই পরিবারের চিরশত্রুতা আরও প্রকট আকার ধারণ করে।
রেশমির বাবা খান বাহাদুর নাজিমউদ্দিন ও রাজের বাবা মির্জা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এর মধ্যে শত্রুতা ও আক্রোশ আরও জোরদার হয়ে উঠে। কিন্তু রাজ রেশমি একে অপরকে খুব ভালোবাসে এবং তাদের সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য বিয়ের আসর থেকে রাজ রেশমিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে রাজ ও রেশমি প্রেমের সমাধি হয় এক করুণ ও ট্রাজেডি ঘটনার মাধ্যমে।
তৎকালীন এই ছবিটি দেখে অনেকেই কেঁদেছিল এবং এমন খবর উঠে আসে যে এই ছবি দেখে তখন পালিয়ে বিয়ে করা দম্পতির সংখ্যা বেড়ে যায় এমন গুজব রটে। ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্র দর্শকের মধ্যে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। এই চলচ্চিত্র দিয়ে সালমান শাহ ও মৌসুমি তাদের প্রথম ছবি দিয়েই বাজিমাত করেন।
পরে আর এই দুই তারকাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এ ছবি আজও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রেমীদের মনের গেঁথে আছে। এছাড়া এই ছবির গানগুলো তৎকালীন যেমন জনপ্রিয় ছিল আজও এত বছর পরও সমান জনপ্রিয়। এ ছবির চমৎকার সুরের সেসব গানে দর্শক-শ্রোতারাও আজও উদ্ভাসিত হয়।
চিত্রপরিচালক সোহানুর রহমান সোহান প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ মেলা তিনটি হিন্দি ছবি ‘সনম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কায়ামত সে কায়ামত তাক’ এর কপিরাইট নিয়ে সোহানুর রহমান সোহানের কাছে আসে এর যে কোন একটির বাংলা পুনঃনির্মাণ করার জন্য। তখন উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা খুঁজে না পেয়ে সম্পূর্ণ নতুন মুখ দিয়ে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন সোহানুর রহমান সোহান।
নায়িকা হিসেবে মৌসুমীকে নির্বাচিত করেন এবং নায়ক হিসেবে প্রথমে নাট্য অভিনেতা তৌকির আহমেদকে প্রস্তাব দিলে তিনি পুনঃনির্মাণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন না বলে পরিচালককে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরে দেশের জনপ্রিয় মডেল নোবেলকে প্রস্তাব দিলে তিনিও তা ফিরিয়ে দেন।
তখন চিত্রনায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীর ‘ইমন’ নামে একটি ছেলের সন্ধান দেন চিত্রপরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে। প্রথম দেখাতেই তাকে পছন্দ করে ফেলেন পরিচালক এবং ‘সনম বেওয়াফা’ ছবির জন্য প্রস্তাব দেন, কিন্তু যখন ইমন ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির কথা জানতে পারেন তখন তিনি উক্ত ছবিতে অভিনেয়র জন্য পীড়াপীড়ি করেন।
তার কাছে কায়ামত সে কায়ামত তাক ছবি এতই প্রিয় ছিলো যে তিনি মোট ২৬ বার ছবিটি দেখেছেন বলে পরিচালককে জানান। শেষ পর্যন্ত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান তাকে নিয়ে কায়ামত সে কায়ামত তাক চলচ্চিত্রটি বাংলা ভার্সনে পুঃনির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ইমন নাম পরিবর্তন করে নায়ক সালমান শাহ এর নাম সালমান শাহ।
এরপর থেকে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন হয়ে উঠেন অমর নায়ক সালমান শাহ। এই চলচ্চিত্রটি বাংলা চলচ্চিত্রের একটি ইতিহাস হয়ে আছে। এই চলচ্চিত্রে সালমান শাহ ও মৌসুমির অভিনয় যেমন প্রশংসনীয় হয় তেমনি রাজিব, আবুল হায়াত ও আহমেদ শরীফের অভিনয়ও খুব প্রশংসা কুড়ায়। দর্শকদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল ছবিটি হিন্দির ছবির নকল।
কিন্তু আদতে তা ঠিক নয়। ছবিটি মূলত হিন্দি ছবিটির কপিরাইট ভার্সন। যা কেবল ভাষা, অভিনেতা ও কলাকুশলী পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ছবিটি নকল নয়। বলা যায় হিন্দির অনুবাদে বাংলা ভার্সনের মৌলিক ছবি।